লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে

লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে
-কাজল দাস

 

তোর পুতুল খেলার সাথী-
আমার একটি মাত্র পুতুল,
ভাগ করে নিয়ে ছিলাম, দু’জনে।
তোর ঘরের চাতাল, আর-
আমার ভাঙা রোয়াক।
এই ছিল আমাদের পুতুল খেলার ঘর।
বড় সুখের ছিল দিনগুলো!

সোমা,
তুই খুব ভালো আছিস, তাই না!
তোর আকাশ ছোঁয়া দালান, শান বাঁধানো উঠোন,
নির্জন ছাদ, কীর্তিমান স্বামী,
সব মিলিয়ে দারুন আছিস তুই।

আর আমি আজ ঘরছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে।
বিক্রি করি হাতের চুড়ি, মাথার চুল, ঠোঁটের রঙ,
কখনো কখনো অসম্পূর্ণ প্রেম।
বাবুরা তো নর্দমার জলও হামলে খায়।
মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে আছড়ে পড়ে লোভী শিয়ালের মতো।
আঁচড়ে তোলে আমার অগ্নিকুন্ডের শিৎকার।
সবটাই আমার দাম দিয়ে কেনে বাবুরা।
যন্ত্রণার দাম ওরা মেটায় টাকায়,
আর আমি মেটাই ঘৃণায়।

দিব্যি আছি বেঁচে!
শুধু মাঝে মাঝে মনটা কেঁদে ওঠে,
যখন দেখি ঘরে ঘরে দুলে ওঠে-
নানা রঙের রাখী বাঁধা হাত-
তখন কি মনে হয় জানিস?
মনে হয় আমি ছুট্টে যাই আমার ছোট্ট ভাইটার কাছে,
যাকে আমি অনেক, অনেক ভালোবাসি।
আর বুকে জড়িয়ে বলি-
“ভাই- দেখ এই হলুদ সুতোটায়-
এক ফোঁটাও রক্তের ছিঁটে নেই!”

কিন্তু পারিনা।
কারণ আমি নষ্ট হয়ে গেছি।
আমি যে নষ্ট হয়ে গেছি-রে!
তবু মায়ের জন্য মনটা ডুকড়ে ওঠে,
মা আমার খুব অসহায়।
আমি জানি সারারাত আমার মা চাঁদ দেখে,
আর এলোমেলো চাঁদের আলোয় খুঁজে বেড়ায়-
তার সোনার টুকরো মেয়েকে।
আমি স্পষ্ট শুনতে পাই- মা কাঁদছে,
আর বলছে-
“ফিরে আয়, ফিরে আয়,
একবার অন্তত ফিরে আয়,
আমি যে তোর অপেক্ষায় দিন গুনছি সোনা।”

-“আমি যাবো মা, আমি তোমার কাছেই যাব,
তোমার কোলে মাথা রেখে সব অপমান,
সব জ্বালা জুড়াবো, আমি যাব!”

জানিস?
তোর ‘জয়’, আমার সম্পূর্ণ পরাজয় নয়।
তোর সুন্দর মুখ আর ভরাট যৌবনের বাঁধ ভেঙে-
মাঝে মাঝে ঢেউ আমার শরীরেও লাগে।
যখন তুই সাপের ছোবলে আত্মসুখে বিভোর হয়ে,
ঘুমিয়ে পড়িস!
তখন সেই সাপ আমার ঘরেও আসে বিষ ঢালতে।
আমার ক্ষত-বিক্ষত স্বপ্নটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বেচতে চায়- ওর অপরাধ বোধ।
আমি তখন হাসি।
ভাবি- সেদিনের মত তোর চাতাল আর আমার রোয়াক।
তোর ঘরে মন ভোলানো প্রেম, আর আমার ঘরে-
উত্তাল প্রেমের নেশা।
এবার বল- ‘জয়’ শুধু কি তোর একার?

শুধু ভয় হয় মেয়েটাকে নিয়ে,
মাঝে মাঝেই বায়না ধরে- বাবার কাছে যাব।
বলে- “জানো মা ঋষির বাবা ঋষিকে সাইকেল কিনে দিয়েছে, ওর কত গাড়ি, কত খেলনা,-
আমার বাবাও আমাকে কিনে দেবে, তাই না মা!”
আমি প্রাণপণে কান্না চেপে হেঁয়ালি করে বলি-
“হ‍্যাঁ মা, কিনে দেবে, তোমার বাবাও তোমাকে কিনে দেবে।”
আমি বৃথাই তাকে বোঝাই,
“তোর বাবা,- তোর বাবা অনেক দূরে থাকে।”
মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, সারাটা দিন বন্ধ ঘরে রাখি, রাতেও তেমন পায় না আমায় কাছে।

একদিন সেও হয়তো সব বুঝবে,
হয়তো লজ্জা ঘৃণায় ফেরাবে ওর মুখ।
ভালই হবে নতুন করে মরতে পারবো সেদিন।

হ‍্যাঁ রে- তুই এখনও আমার কথা ভাবিস?
আমার কিন্তু বেশ মনে পড়ে, তোর রঙচঙে মুখ,
তোর জামার ভেতর গুছিয়ে রাখা শরীর-
যা দিয়ে আঘাত করলি আমায়!
আমি বোকা, আসলে বুঝিনি প্রেমের মানে।
তোর কাছে এ ব্যাপারে আমি বরাবরই কাঁচা।
দারুণ তোর খেলা,- “এক তিরে দুই নিশানা”
এখন আর বলে কি হবে!
পারিনি সেদিন বেপরোয়া হয়ে উঠতে,
নষ্ট হওয়ার বড় ভয় ছিল যে, আমার।
যদি পারতাম, তবে আজ তোর ঠিকানাও
কালীঘাটের আশেপাশে হতে পারতো,
-আমার মত।
আমার মত তুইও আগুন হয়ে পুড়তিস,
তোর নামেরও আগে-পরে শিরোপা বসতো,
তোর শরীর জুড়েও থাকতো বাবুদের দেওয়া শীলমোহর।
কেউ আদর করে তোকে চুমকি বলে ডাকতো,
কেউ আবার রানী।
আঁধারের বুক চিরে তোর ঐ সাদা চামড়া মোড়া মুখ, রং-বাহারী ঠোঁট, আর পাগল করা যৌবন,
কোনটাই সমাজের ইতিবাচক আলোয়-
তুলে আনতে পারতিস না, কোনো দিনই।
কোথায় থাকতো তখন, তোর আকাশ ছোঁয়া দালান, শান বাঁধানো উঠোন, নির্জন ছাদ আর-
আমাকে ঠকিয়ে নেওয়া, তোর কীর্তিমান স্বামী!
তখন-
তুইও আমার মতো ‘লক্ষীছাড়া’ নষ্টমেয়েই হতিস।
…………. নষ্ট মেয়েই হতিস

Loading

Leave A Comment